হিমালয় কন্যা পঞ্চগড়

বাংলাবান্ধা থেকে গন্তব্য এবার কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেট। সমতলের এই চা বাগান নিয়ে প্রচুর হাইপ দেখে আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম তেঁতুলিয়া আসলে মিস করা যাবে না এই হালের ক্রেজ। সিলেটের চা বাগানের স্বাদ তো অনেক নেওয়া হলো এবার না হয় নেওয়া যাক সমতলের চা বাগানের স্বাদ। ওয়াফি ঈসমাইল ভাই কোনো বিষয় নিয়ে ব্যাপক তর্কে ব্যস্ত। আর আমি হারিয়ে আছি নিজের মাঝে।

তেঁতুলিয়ায় যদি একটা বাড়ী করা যেত। যদি হতে পারতাম এখানে সেটেল। ইট পাথরের ওই বিষাক্ত নগরীটা ছেড়ে চলে আসতাম এখানে। কী ভাগ্য তাদের, যারা ঢাকার বাহিরে জেলা শহরে বড় হয়েছে। এদেরকে দেখলে আমার রীতিমতো হিংসা হয়। কল্পনার জগতের হেয়ালী ভেঙে এসে পড়লাম কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেটে ঢোকার রাস্তায়।

সমতল ভূমির পাকা রাস্তায় এগিয়ে চলছে আমাদের অটো। আর আমি যেন প্রবেশ করলাম এক রাশ সবুজের জগতে। দু পাশে সবুজের সমাহার। সবুজ আমায় যেন সম্মোহন করেছে। ওপাশে সীমান্তের কাঁটাতার আর এ পাশে বাংলাদেশ। দু পাশে দিয়েই দেখা যাচ্ছে সমতলের চা বাগান। কী অবাক ব্যাপার। সমতল ভূমিতেও যে চা বাগান হতে পারে তা হয়তো তেঁতুলিয়া না এলে টের পেতাম না। পৃথিবী এত সুন্দর তা না ঘুরলে বোঝা বড় দায়।

যেন এক সবুজ মখমলের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে সমতলের এই চা বাগান। চা বাগানের নারী কর্মীরা কাঁধে সাদা ব্যাগ ঝুলিয়ে অবিরাম তুলে যাচ্ছে সবুজের স্বপ্ন। এই সবুজ পাতার কুঁড়িতেই তো বন্দী ওদের জীবন। আমার কাছে এই সবুজ নয়াভিরাম হয়ে ধরা দিলেও এ সবুজ ওদের কাছে যে বড় ফিঁকে। চা কর্মীদের জীবনের সাথে সংযুক্ত আমাদের জুয়েল রানা ভাইয়ের কথা মনে পড়লো। এদের বেতন এত কম, এরা এদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষিতও করতে পারে না। আর ক্ষণে ক্ষণে যক্ষ্মার আতংকে এদের দিন যায়। সবুজের মাঝে এসে এ সব কথা ব্রাত্য রেখে সবুজের কান্না আর শুনতে চাই না।

শেড ট্রি হিসাবে জারুল গাছগুলো বেশ ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে জারুল গাছের বেগুনী ফুল সবুজের মাঝে সূর্যের অল্প আলোয় প্রতিফলিত হয়ে এক অদ্ভুত ঘোরের তৈরি করেছে। সবুজ পাতার মাঝে বেগুনী রং এর ফুল মৃদু বাতাসে কাঁপছে। আস্তে আস্তে সবুজের এই ঘোর কাটিয়ে চলে এলাম আনন্দধারা রিসোর্টের গেটে।

গেটে এসে ঈসমাইল ভাই তাদের সাপ্লায়ার পরিচয় দিতেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি সাপেক্ষে আমাদের ঢুকতে দিল। ঢুকে আমরা যেন স্তম্ভ হয়ে গেলাম। বলতে হবে কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেটের মালিক বেশ রুচিশীল। কৃত্রিমতাকে আমি এড়িয়ে চলি। সেই আমিই ভাবি মানুষের তৈরি একটা রিসোর্ট এত সুন্দর হবে, কল্পনাই করা যায় না। পুরো রিসোর্টই যেন শিল্পীর নিপুণ হাতের ছোঁয়া পেয়েছে।

রিসোর্টের চৌচালা কাঠের বাড়ীগুলো সাথে সমন্বয় করে তৈরি ওয়াকওয়ে আর তার পাশে দিয়ে সবুজের এত বিস্তর খেলা পথিককে অবশ্যই আর্কষিত করবে। চারপাশে গৃহপালিত গরুর বিচরণ দেখতে লাগলাম। আরও এগিয়ে দেখতে পেলাম চারপাশে কাঁটাতার দেওয়া। কাঁটাতারের বাহিরের একটা চিকন রেখার ঝিরি দেখলাম। বর্ষায় হয়তো পানিতে টই টুম্বুর থাকে। এরই মাঝে একটা সবুজের ভুলভুলাইয়া টাইপের ওয়াক ওয়ের খোঁজ পেলাম। যেখানে পথিক হারিয়ে যাবে সবুজের মাঝে।

এত সবুজের বর্ণনার ছড়াছড়ি কিছুটা বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে। তবে যা বলছি এ সব কথা মিছে নয়। এর মাঝে দেখলাম এক ভদ্রলোক আমাদের সাথে কথা বলতে আসলেন। তিনিই মূলত আমাদের ভিতরে ঢোকার অনুমতি দিয়েছেন। উনি এসে জানালেন আজকে অতিথি আসবে এখানে, আমরা যেন একটু তাড়াতাড়ি করি। এই স্বর্গীয় সৌন্দর্য ছেড়ে যে যেতে ইচ্ছে করে না, যেতে তো হয়।

সদ্য পরিচিত হওয়া এক ভদ্রলোক আমাদের মতোই বেড়াতে এসেছেন। উনি উনার স্ত্রীকে নিয়ে এখানে অনেক বার রাত্রিযাপন করেছেন। সন্ধ্যার পর চা পাতায় চাঁদের রূপালী আলোয় সৃষ্টি করে এক মায়াবী রূপ। ঝি ঝি পোকা ডেকে ওঠে আপন খেয়ালে। হাজার হাজার ঝি ঝি পোকা যুক্ত জোনাক রাতে স্বপ্নবিলাসী মানুষদের সময় কাটে নির্ঘুম।

সুন্দর কিছু সময় কাটিয়ে আমরা বের হলাম আনন্দধারা রিসোর্ট থেকে। হাঁটছি চা বাগানের এই মায়াভরা মধু মাখা দুপুরে। চারদিকে এক স্বর্গীয় শান্তি। এর মাঝে হারিয়ে যেতে গিয়েও বেরসিক ওয়াফির ডাকে ফিরে আসি বাস্তবে। ওয়াফিকে দেখতে পেলাম দু পা চেপে দাঁড়িয়ে আছে। আর ত্রাহি ত্রাহি ডাকছে, ওই ঈসমাইল ভাই, আমাকে প্রকৃতি ডাকছে।

স্থানীয় এক লোককে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই এখানে আশেপাশে কোনো টয়লেট আছে? উনি বললেন আশেপাশে তো নেই, তবে দুই মিনিট হাঁটলেই কাজী কোম্পানির মীনা বাজার আউটলেট আছে, সেখানে টয়লেট পাবেন। আমরা একথা ওয়াফিকে জানালাম কিন্তু ওয়াফি আমাদের কথা শুনলেন না উনি শুনলেন প্রকৃতির ডাকের কথা। আসলে প্রকৃতির ডাকের কাছে তো মানব বড় নিরুপায়, বড় অসহায়।

ওয়াফি আবার গগন বিদারি চিৎকার দিয়ে উঠলো, ওই ঈসমাইল ভাই, টিস্যু দেও না। ঈসমাইল ভাই সবিনয়ে জানতে চাইলো, ওয়াফি, এখানে কোথায় কী করবে? ইংগিতে মোটু ওয়াফি পাট ক্ষেত দেখালো না চা বাগান দেখিয়ে দিল। বেচারার বেগতিক অবস্থা দেখে ঈসমাইল ভাই তার কাছে থাকা টয়লেট টিস্যুর পুরো প্যাকেট দিয়ে দিলেন। ওয়াফি গেল চা বাগানে লোটা ছাড়া। গভীরে ঢুকে গেল। আমরা বাহিরে পাহারা দিচ্ছি।

ওয়াফি চা বাগাম থেকে বিজয়ীর বেশে বের হলো। চোখে মুখে হাসির ঝিলিক। ওয়াফিকে অবাক করে ঠিক ঘড়ি ধরে দুই মিনিট হাঁটার পর মীনা বাজার পেলাম। এবং পেয়ে গভীরভাবে অনুভব করলাম এক মিনিটের নাই ভরসা। যাই হোক, ঢাকার মীনা বাজার থেকে এই মীনা বাজার কিছুটা ভিন্ন। এখানে কাজী ফার্মের দুগ্ধ প্রোডাক্ট আর বিভিন্ন জাতের চা পাতা দেখতে পেলাম। বিক্রয় কর্মীর কাছে আমরা নতুন তথ্য পেলাম। এ দেশে একমাত্র অর্গানিক এবং দার্জিলিং প্রজাতির চা এই তেঁতুলিয়ার বাগানগুলোতেই হয়। এখানে কাজী এন্ড কাজীর চা বাগান ছাড়াও রয়েছে ডাহুক, স্যালিলেন এবং তেঁতুলিয়া টি এস্টেট।

দেখতে দেখতে কাজী সাহেবকে আমাদের বিদায় দেবার সময় হয়ে গেছে। ঘড়িতে বেশ বেজে গেছে। তবে তেঁতুলিয়া এসে আগেই ঢাকার বাসের টিকেট কেটে ফেলেছি বিধায় চিন্তা মুক্ত। এবার তেতুলিয়ার শেষ পর্বের দিকে আমাদের পা বাড়ানো।

Source: Ashik Sarwar‎ <Travelers of Bangladesh (ToB)

 

Share:

Leave a Comment