স্বচ্ছ জলের গ্রাম সোনাংপেডেং

ভারতের মেঘালয় ঘুরতে যেতে চান কিন্তু অফিস থেকে বড় ছুটি পাচ্ছেন না অথবা আকাশে লক্ষ তারার মেলা, গৃহত্যাগী জোস্নাময় শীতের রাতে পাহাড়ি নদীর ধারে তাবুবাস করতে চান সাথে ক্যাম্প ফায়ার, অথবা স্বচ্ছ জলের বহমান পাথুরে নদীতে ঝাপাঝাপি অথবা স্নোরকেলিং/ কায়াকিং/বোটিং করতে চান তবে এই ট্যুরটি আপনার জন্য। মাত্র দুই দিন সময় হাতে নিয়েই ঘুরে আসতে পারেন মেঘালয়ের স্বচ্ছ জলের গ্রাম “সোনাংপেডেং”।

সোনাংপেডেং ভারতের মেঘালয় রাজ্যের জৈন্তা হিলস জেলার অন্তর্গত একটি পাহাড়ি অপরুপ গ্রাম। গ্রামটি বাংলাদেশের তামাবিল বর্ডার থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার এবং মেঘালয়ের রাজধানী শিলং থেকে ৯৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সোনাংপেডেং এর সৌন্দর্যের প্রধান আকর্ষন এই গ্রামের ভিতর দিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ, সবুজ জলের পাথুরে নদী “উমংগট”। এই নদীটিই জাফলং সীমান্ত দিয়ে গোয়াইন নদী নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উল্লেখ্য এই নদীর বাংলাদেশে প্রবেশ মুখেই সিলেটের বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র জাফলং অবস্থিত।সোনাংপেডেং যেতে হলে ভিসায় পোর্ট “বাই রোড ডাউকি” থাকতে হবে। তো চলুন ঘুরে আসি স্বচ্ছ জলের গ্রাম “সোনাংপেডেং”।

সকাল ৫ টা, সিলেটের কদমতলী বাসস্ট্যান্ড। ঢাকাতে শীত না থাকলেও সিলেটে যে শীত বিদ্যমান তা ভালো ভাবেই বুঝতে পারছিলাম। বাস থেকে নেমে নাস্তা সেরে সকাল ৯ টার মধ্যে চলে আসি তামাবিল স্থলবন্দরে। পোর্ট এ কোন ভীড় নেই। কিন্তু এখানেই ঘটলো বিপত্তি। পোর্ট এ এখন আর ট্রাভেল ট্যাক্স দেয়া যায় না। ট্রাভেল ট্যাক্স জমা দিতে হবে জৈন্তাপুর এ। কি আর করার আবার বেক করে জৈন্তাপুর এসে ট্রাভেল ট্যাক্স জমা দিয়ে আবার পোর্ট এ আসতে আসতে ঘড়িতে সময় ১০.৩০ মিনিট।

ভীড় নেই, খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ সাইডের ইমিগ্রেশন শেষ করে প্রবেশ করলাম ভারত ভূখন্ডে এবং ভারতীয় ইমিগ্রেশন শেষ করে ইমিগ্রেশন ভবনের সামনে জীপ স্ট্যান্ড হতে চার আসনের গাড়ি রিজার্ভ করে ফেলি। আমাদের প্রথম গন্তব্য ক্রাংসুরি ফলস। গাড়ি আমাদের ডাউকি বাজার হয়ে ক্রাংসুরি ফলস ঘুরিয়ে সন্ধায় সোনাংপেডেং এ নামিয়ে দেবে। ভাড়া ২০০০ রুপি। ডাউকি বাজার থেকে আমরা সিম ও রুপি সংগ্রহ করে নেই। আমাদের মূল লক্ষ্য সোনাংপেডেং এ ক্যাম্পেইন হলেও ক্রাংসুরি ফলস দেখাটা ট্যুরের বাড়তি পাওনা।

প্রতিবার সিলেট ঘুরতে এসে মেঘালয় পাহাড় গুলো দেখে দেখে ছুতে না-পারার মন খারাপের গল্পগুলোর আজ বিপরীত দিক, গাড়ি ছুটে চলছে মেঘালয় পাহারের উপর দিয়ে। মাঝে মাঝে গাড়ির জানালা দিয়ে পাহাড়ের নিচে চোখে পরছে আমার প্রিয় বাংলাদেশ। ডাউকি টু ক্রাংসুরি ফলস যাওয়ার রাস্তার সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত হয়ে রাস্তার প্রতিটি বাঁকে বাঁকে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ছবি তোলার ইচ্ছাটা অনেক কষ্টে দমন করতে হচ্ছিলো৷ ঘন্টাখানেকের মধ্যে আমরা চলে আসি ক্রাংসুরি। গাড়ি থেকে নেমে প্রথমেই ঢুকে পরি রেষ্টুরেন্টে কারন এখনো দুপুরের খাবার খাওয়া হয়নি। প্রচুর ক্ষুধার্ত, তাই আগে চাই পেট পুজো।

পেট পুজো শেষে পাহাড়ের বুকে বানানো সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে শুরু করলাম৷ অল্প কিছু সময় নামার পর দূরে দৃশ্য মান হলো ক্রাংসুরি ফলস। ফলসের উপরিভাগটা দেখতে অনেকটা নদী মতো। যার সামনে একটি বাঁধ দেওয়া আছে। আর সেই বাঁধ থেকেই পানি উপচে ফলস এ পরছে। প্রায় দশ পনেরো মিনিট নিচে নামতেই পেয়ে গেলাম ক্রাংসুরি ফলসের টিকেট কাউন্টার। এখান থেকে জন প্রতি ৫০ রুপি করে টিকেট সংগ্রহ করে প্রবেশ করি নীলপানি’র ঝর্ণাকুন্ড ক্রাংসুরি ফলস।

বর্ষায় ঝর্ণার যে যৌবন ফুটে উঠে এখন তা নেই। পানির পরিমান খুবি কম কিন্তু এখন এক অদ্ভুত সৌন্দর্য নিয়ে বসে আছে ক্রাংসুরি। কাচের মতো স্বচ্ছ পানি, উপর থেকে মনে হচ্ছিলো গারো নীল।৷ ঝর্ণার এমন স্বচ্ছ ও নীল রং এর আগে কখনো দেখিনি। ঝর্ণার সৌন্দর্য দেখে স্বচ্ছ জলে ঝাপ দেয়ার চিন্তাটা মাথাথেকে ঝেরে ফেলতে হলো জলে পা দেয়ার সাথে সাথে। ভয়ংকর রকমের ঠান্ডা পানি। এই পড়ন্ত দুপুরে এক মাত্র আকিব ভাইই আমাদের মধ্যে পানিতে নামার সাহস দেখান। যদিও পানি থেকে উঠার পর যা ঘটেছিলো তা ইতিহাস। এই জলে নামতে হলে ৩০ রুপি দিয়ে লাইফ জ্যাকেট ভাড়া করে নামতে হবে। লাইফ জ্যাকেট ছাড়া কাউকে পানিতে নামতে দেওয়া হয় না। আপনি চাইলে ঝর্ণার উপরিভাগে বাঁধের ওপাশে নীল জলে লাল রঙের বোটে বোটিং করতে পারেন। আমরা ঝর্ণায় সৌন্দর্য দেখে এতটাই বিমোহিত হয়েছিলাম যে ঐ দিকে যাওয়ার ইচ্ছেই হয় নি।

হিম হিম ঠান্ডা বাতাস৷ সন্ধা গড়িয়ে রাতের আধার গ্রাস করে নিয়েছে প্রকৃতিকে। এমন সময় আমরা পৌছলাম সোনাংপেডেং এ। সোনাংপেডেং এ ঢোকার সময় “সোনাংপেডেং ডিফেন্স পার্টির” কাছথেকে ৩০ রুপি দিয়ে গাড়ি প্রতি প্রবেশ টিকেট নিতে হলো।

এবার আমাদের ট্যুরের মূল আকর্ষন সোনাংপেডেং এর উমংগট নদীর তীরে তাবু বাসের পালা। দ্রুত তাবু ভাড়া করে ফেলি। তাবু আমাদের ফেলতে হয়নি, যাদের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছি তারাই ফেলে দিয়েছে। দুই জনের সাইজের তাবু ভাড়া ৭০০ রুপি এবং ৩ জনের সাইজের তাবু ১০০০ রুপি। আপনারা চাইলে কটেজেও থাকতে পারেন। তবে সোনাংপেডেং এ ক্যাম্পেইন কারাটাই আমার মতে বেষ্ট। ক্যাম্প সাইটের হোটেলে রাতের খবারের অর্ডার দিয়ে দেই। খাবার তাবুতে পাঠিয়ে দেবে। আপনারা চাইলে হোটেলে এসে খেতে পারেন।

নদীর পাশে বালুর উপর আমাদের তাবু ফেলা হয়েছে। প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাস, তাবুর সামনে পাথড়ের উপর বসলাম, আকাশে অদ্ভুত চাঁদটি নেই কিন্তু লক্ষ লক্ষ তারা জ্বল জ্বল করছিলো। আর সামনে নদীর ওপারে বিশালাকার সুউচ্চ পাহাড় টা আধারে মনে হচ্ছিলো বড় পর্দার মতো। আমাদের তাবুর আসেপাশে অনেক গুলো তাবু। বেশ কিছু তাবুর সামনে ক্যাম্প ফায়ার জ্বল ছিলো। রাতের আধার নদীর জলের স্বচ্ছতাকে গ্রাস করে নিলেও ক্যাম্প ফায়ারের আলো আর পাথুরে নদীর জল-পাথরের অপূর্ব সংগীত দুই মিলে তৈরি করছিলো এক অদ্ভুত মাদকতা, এরই মাঝে আকিব ভাই নিজের গলায় ধরে ফেললেন “বেধেছে এমনো ঘর শূন্যের উপর পোস্তা করে….. ধন্য ধন্য ও বলি তারে…..।

যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন সময় সকাল ৭ টা। বাহিরে প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাস। অলসতা ঝেরে ফেলে তাবু থেকে বের হয়ে গেলাম কারণ দিনের আলোয় এখনো সোনাংপেডেং দেখা হয়নি। ক্যাম্পেইন জোনের পাশেই রয়েছে পর্যটকদের জন্য বাথরুম ও ফ্রেশ হওয়ার স্থান। ফ্রেশ হয়ে, নাস্তা করে প্রথমেই চলে যাই সাসপেন্স ব্রীজে। ব্রীজের উপর থেকে নিচে নদীর স্বচ্ছ জল দেখতে গাড়ো নীল। পানির নিচে প্রতিটি পাথর দেখা যাচ্ছিলো। ক্যামেরার প্রতিটি ক্লিকে পানির রং এর ভিন্নতা ধরা পড়ছিলো। নৌকা গুলো দেখে মনে হচ্ছিলো যেন স্বচ্ছ কাচের উপর ভাসছে। সাসপেন্স ব্রীজই সোনাংপেডেং এর সৌন্দর্য উপভোগ করার বেষ্ট স্থান।

ভয়ংকর ঠান্ডা পানি। কিন্তু এই জলে ঝাপাঝাপি করার লোভ সামলানো সম্ভব নয়। তাই সূর্যে তাপ একটু বাড়ার অপেক্ষায়। মধ্য গগনে সূর্য। ৫০ রুপি দিয়ে লাইফ জ্যাকেট ভাড়া করে নেমে পরলাম হাড় কাপানো ঠান্ডা জলে (লাইফ জ্যাকেট নেয়া বাধ্যতামূলক)। কখন যে চলে গেছে ২ ঘন্টা বুঝতেই পারিনি। যদিও আমাদের আজ দেশে ফিরতে হবে। অবশ্য এটা কোন সমস্যা না কারন পোর্ট খোলা থাকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত (ইন্ডিয়ান সময়)। তাই ঠান্ডা কে জয় করে আরামছে ঝাপাঝাপি চলতে থাক।

দুপুর ৩ টা। সোনাংপেডেং কে বিদায় জানিয়ে গাড়ি রিজার্ভ করে চলে আসি ডাউকি বাজার (সোনাংপেডেং টু ডাউকি বাজার লোকাল গাড়িউ আছে)। আপনারা চাইলে সোনাংপেডেং থেকে সরাসরি পোর্ট এ চলে যেতে পারেন। আর যদি আমাদের মতো হাল্কা কেনাকাটা করতে চান তবে চলে আসুন ডাউকি বাজার। ডাউকি খুব ছোট একটি বাজার। খুব বেশি কিছু নেই। তাই টুকটাক কেনাকাটা করে মেঘালয় কে বিদায় জানিয়ে দেশের পথে।

নদী বা ঝর্নার পানিতে অপচনশীল কিছু ফেলবেন না। পরিবেশর ক্ষতি হয় এমন কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকুন।

Source: Ariful Rajib‎<Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment