যাত্রা বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নের দুর্গম এলাকা

আমাদের যাত্রা ছিল বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নের নাফাখুম এবং দুর্গম নাক্ষিয়ং এর দেবতাপাহাড় >আমিয়াখুম>ভেলাখুম>সাতভাইখুম।

 

১ম দিন- কুমিল্লা থেকে রাত ১২.৪৫ টায় সৌদিয়া বাসে (টিকিট ৬২০) যাত্রা শুরু করে সকাল ৬.০০ টায় বান্দরবান শহরে পৌছয়ে যাই। বাস থেকে নেমে নাস্তা শেষ করে চান্দের গাড়ি রির্জাভ (৫৫০০৳) করে থানচির উদ্দেশ্য রওনা দেয়। যেতে যেতে পথে চঁাদ উঠেছিল না মেঘের সমুদ্র দেখা মিলছিল.এই সমুদ্রের বর্ননা হয়ত লিখে বা ক্যামেরা বন্দী করে বুঝানো যাবে না স্বয়ং নিজ চোখে না দেখিলে।

 

 

 

বেলা ১১ টার দিকে আমরা থানচি পৌছে যাই, থানচি থেকে ১০-১২কি.মি আগে বিজিবি চেকপোস্ট পরে, সেখানে আমাদের সবার আইডি কার্ডের ফটোকপি জমা দিয়ে নাম ঠিকানা লিখে এন্ট্রি করতে হয় NID, Varsity ID, Birth certificate যেকোন একটা দিলেই হয়। বিজিবি এর একটা ক্যাফে আছে ওখানে স্থানীয় বাগানের একদম ফ্রেস পেপে, কমলার জ্যুস পাওয়া যায়, চায়লে ট্রাই করে দেখতে পারেন।কয়েকদিন আগে থেকেই ১৩০০০টাকা দিয়ে লোকাল গাইড + নৌকা(আপ ডাউন) ৩ দিনের জন্য গাইড ঠিক করে রেখেছিলাম। আমাদের গাইড ছিলেন রাফায়েল দাদা। আমিয়াখুম,ভেলাখুম,সাতভাইখুম,দেবতা পাহাড় যাওয়ার ২ টা পথ আছে, একটা হল পদ্দঝিরি হয়ে ৭-৮ ঘন্টা ট্রেকিং করে থুইশাপাড়া দিয়ে, আর একটা হল রেমাক্রি হয়ে নাফাখুম দিয়ে জিন্নাপাড়া-থুইশা পাড়া হয়ে, দুই পথের মজা নেওয়ার জন্য আমরা রেমাক্রি হয়ে যায় ফেরার সময় পদ্মঝিরি হয়ে ব্যাক করি , তো গাইড ওইভাবেই সব ঠিক করে রেখেছিল। থানচি পৌছানোর পর রাফায়েল দাদার মাধ্যমে থানা,বিজিবি থেকে সব ধরনের ফর্মালিটিস পূরন করে আগামী ৩/৪ দিনের জন্য বাসায় শেষ বারে মত কথা বলি।কারন সাঙু নদীতে একটু এগিয়ে গিলে আপনি নেটওয়ার্কে বাইরে চলে যাবেন, বেলা ১ টার দিকে লাইফ জ্যাকেট, পানি, স্যালাইন,গ্লুকোজ, শুকনো খাবার কিনে নৌকায় উঠে পরলাম সাংঙু নদী দিয়ে রেমাক্রি যাওয়ার জন্য। কেননা পরে আর তেমন কোন খাবার কিনতে পাওয়া যাবে না।।সাংগু নদী আর বড় পাথরের অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে ২/৩ ঘন্টা অতিক্রম করার পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম রেমাক্রি, গাইড আমাদের থাকার জন্য রেমাক্রিতে একটা কটেজ ঠিক করে রেখেছিল, খাওয়ার ব্যবস্থাও ওখানেই। রেমাক্রি পৌছে সাঙু নদীতে রেমাক্রি ঝিরিতে কিছুক্ষণ ঝাপাঝাপি করে সেদিনের মত বিশ্রাম। রাতে রেমাক্রি বাজারে কিছুক্ষন ঘুরে কটেজে আসলাম, এরপর আকাশের তারা গুনতে গুনতে আর দূর থেকে আসা রেমাক্রি ঝিরির মৃদু গর্জন শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পরলাম। মনে হলো জীবন এত সুন্দর কেন!

 

 

 

২য় দিন- আমরা রেমাক্রি থেকে নাফাখুমের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করব। যাই হোক সকালে রেমাক্রি বাজার থেকে পরোটা ডিম ভাজি দিয়ে নাস্তা করলাম। এরপর কটেজের আনুষঙ্গিক খরচ শেষ করে ব্যাগসহ সকাল ৮ টাই নাফাখুমের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পাহাড়ের পাদদেশ ঘেষে বড় ছোট ঝিরিপথ দিয়ে হাটতে হাটতে হঠাৎ দেখামিল আরাকান আর্মির। দৃষ্টির অগচোরে আরাকান আর্মির নাম শুধু বইয়ের পাতা বা খবরে কাগজেই শুধু পড়সিলাম কিন্তু হঠাৎ সামনে আসাতেই অস্ত্রধারী বাহিনী দেখে যেমন আনন্দে আত্মাহারা হয়লাম তেমনই অনিশ্চিত ঝুকিতে বুকের ভিতর দুরুদুরু করে কাপছিল।হয়ত তখনই থেমে যেতে জীবন প্রদ্বীপটা কিন্তু সৌভাগ্য আমাদের তারা যথেষ্ট শান্তকামী এবং তাদের বিষয় ধারনাটা ভূল তার হিংস্র নয়। প্রায় আড়াই ঘন্টা পর নাফাখুমের অপার সৌন্দর্য দেখে কোথায় যেন সব ক্লান্তি উড়ে গেল। বাংলার নায়াগ্রার ঠান্ডা হিমশীতল পানিতে গোসল করে রোদ পোহানো হল কিছুক্ষন এরপর শুকনো কিছু খাবার খেয়ে রওনা দিলাম জিনাপাড়ার উদ্দেশ্যে। সূর্য ততক্ষণে মধ্যগগনে ঘড়িতে বাজে ১.৪৫, এমনিতেই টানা হাটার পর গোসল তারপর আবার হাটা, শরীর যেন চলতেই চায় না কষ্ট হলেও হেলেদুলে হাটতে হাটতে বিকাল ৫ টায় জিনাপাড়াতে পৌছালাম। চারদিকে পাহাড় আর নেটওয়ার্ক এর চিহ্ন মাত্র নেই শুধু এরপর সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে বসে সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে গান, আড্ডা আর রাতে ঝিঝি পোকার আওয়াজ কি যে অসম্ভব সুন্দর অনুভূতি যা লিখতে গেলে হাজার রাত পার হয়ে যাবে।

 

 

 

৩য় দিন- ভোর ৬ টায় নাস্তা করে কটেজ বিল মিটিয়ে থুইসাপড়ার উদ্দেশ্য রওনা, ৩০ মিনিট পর থুইসাপাড়া পৌছায় কটেজে ব্যাগ রেখে আমাদের মূল সফর শুরু (গাইড আগে থেকে কটেজ ঠিক করে রেখেসিল থুইসা পাড়ায়) গাইড আগের রাতে জানিয়ে দিয়েছিলেন আজকে তিনটি পাহাড় পার হতে হবে এর মধ্যে একটি দেবতা পাহাড় যার নাম শুনলেই মেরুদন্ড দিয়ে ছোটখাট শীতল স্রোত বয়ে যায়। জেনে রাখা ভালো আমরা যেগুলোকে পাহাড় বলি স্থানীয়রা সেটাকে টিলা বলে। থুইসাপাড়া থেকে সকাল ৮.০৪ টাই আমরা আমিয়াখুমের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আগেরদিন টানা হাটার কারণে দেবতা পাহাড় পৌছানোর পূর্বেই আমাদের দলের একজন প্রকৃতির কাছে হার মেনে ফেরত চলে গেল। বাকি সদস্য নিয়ে দেবতা পাহাড় যখন পৌছালাম তখন আমাদের আনন্দ দেখে কে! এরপর শুরু হল প্রতি পদে পদে বিপদ আর রোমাঞ্চ, একবার পা হড়কে গেলে কি হবে তা আর ভাবতে চাই না। দেবতা পাহাড় থেকে আমিয়াখুম এর সেই গর্জন নতুন করে উদ্দীপনা তৈরি করল আমাদের মাঝে তারপর সম্পূর্ণ খাড়া একটি পাহাড়ের খাজে খাজে মাটির রাস্তা ধরে নামতে আমাদের মোটামুটি ১.৩০ ঘন্টার মত সময় লাগলো। এরপর হাতের ডান দিকে কিছুক্ষন হেটে ভেলাখুমের দিকে যাওয়া শুরু করলাম। উচু নিচু পাথরের মাঝ দিয়ে পাথুরে রাস্তা দিয়ে সতর্কতার সাথে হেটে সবুজ স্বচ্ছ শান্ত জলধারার এক পাড়ে এসে দাড়ালাম এখান থেকে আমাদের ভেলায় করে যাত্রা শুরু হবে। রাফায়েল দাদা আগেই ভেলা ঠিক করে রেখেছিলেন। ভেলাখুমের জলরাশি আর দুপুরের কড়া রোদ মিলেমিশে এক অন্যরকম অনুভূতি। ভেলাখুম দেখা শেষে যে পথে এসেছি ওই পথেই ১৫ মিনিট হাটলেই দেখা মিলবে আমিয়াখুম, আমিয়াখুম এর সামনে প্রবল জলরাশির কাছে গিয়ে সব কষ্ট সার্থক মনে হলো। একটু আগালেই দেখা মিলবে সাতভাইখুম, এরপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে এরপর বেশ বড় কিছু পাথরের উপর দিয়ে হক্ষ্যংমুখে গোসল করে আমরা দেবতা পাহাড়ের দিকে যাত্রা শুরু করলাম,এখন উঠার শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই কিভাবে উঠেছি নিজেও জানি না, সময় লাগলো প্রায় ৪০ মিনিট। বিকালে পরিশ্রান্ত অবস্থায় থুইসাপাড়া আসার পথে পাহাড়ের মাঝে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে আসার যে অনুভুতি বেঁচে থাকলে আবার আসার সংকল্প করলাম

 

 

 

৪র্থ দিন- অফিসিয়ালি ট্যুর শেষ, কিন্তু পদ্মঝিরি আমাদের ডাকছে। দীর্ঘসময় থুইসাপাড়া থাকায় হঠাৎ কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে, স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট এর যুগে নেটওয়ার্কবিহীন এলাকায় নিয়ম করে সন্ধ্যায় সবাই চা খেতে খেতে আড্ডা দেয়া আর হবে না। কিন্তু সকল মায়া ত্যাগ করে আমাদের রওনা দিতে হবে। থুইসাপাড়া থেকে পদ্মমুখ পর্যন্ত হাটার গতির তারতম্যের বিচারে আসতে সময় লাগে ৬-৮ ঘন্টা। সকাল ৭টাই থুইসাপাড়া থেকে বিদায় নিয়ে পদ্মঝিরির দিকে হাটা শুরু হলো আমাদের। পাঁচটা পাহাড় আর দুই-তিনটা টিলা পার হয়ে হরিশ্চন্দ্রপাড়া পৌছাতে বেলা ১ টা বেজে গেলো। এর মাঝে আমাদের গাইড রাফায়েল দাদা দূর থেকে আমাদের তাজিংডং আর সাকা হাফং পাহাড় দেখিয়ে দিলেন। অফিসিয়ালি তাজিংডং বাংলাদেশের সবচেয়ে উচু পাহাড় কিন্তু পাহাড়িদের মতে তাজিংডং সাকা হাফং এর অর্ধেকও না।হরিশ্চন্দ্র পাড়ার জুমঘরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে এখান থেকেই পদ্মঝিরিতে নেমে গেলাম আমরা। আলোআধারি পরিবেশ আর দুইপাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা ছোট বড় ঝিরি দিয়ে তৈরি চমৎকার এক পথের নাম পদ্মঝিরি সেই ঝিরির উপর দিয়ে হাটতে হাটতে বিকাল ৫ টায় আমরা পদ্মমুখে পৌছে বোটে উঠে থানচিতে চলে আসলাম। অতঃপর চান্দেরগাড়ি রির্জাভ করে আলীকদম হয়ে চকরিয়া এসে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে শহরের এখানে সেখানে ঘুরে রাতের বাসে কুমিল্লা চলে আসলাম।

 

 

 

পুরো ট্যুরে আমাদের জনপ্রতি খরচ ৪৬০০টাকা।আমরা ছিলা ১২ জন
খরচ সমূহ
কুমিল্লা-বান্দরবান ৬২০(সৌদিয়া)
বান্দরবান-থানচি চান্দের গাড়ি ৫৫০০
রেমাক্রি এবং থুইসাপাড়া থাকা জনপ্রতি ১৫০টাকা আর খাওয়া ১২০-১৫০ টাকা
থানচি থেকে চকরিয়া চান্দের গাড়ি ২৫০০ টাকা
গাইড নৌকা খরচ ১৩০০০ টাকা

 

 

 

ট্যুর উপযোগী যে জিনিস গুলি নিতে হবেঃ
NID,Varsity Id Or B.Certificate ৫ কপি photocopy
ব্যান্ডেজ
প্রচুর স্যালাইন
এংলেট
ট্রেকিং শু(থানচি বাজারে পাওয়া যায়, দাম ১৫০টাকা)
প্যারাসিটামল এবং গ্যাস্ট্রিক জাতীয় ঔষধ
খেজুর,বাদাম,চকলেট,নুডুলস
বিঃদ্র- আপনার দ্বারা পরিবেশের যেন ক্ষতি না হয় সেটা অবশ্যই খেয়াল রাখবেন।প্লাস্টিকের বোতল চিপস এর প্যাকেট এগুলো ফেলে আসবেন না। যেকোন একটি পলিথিনে আপনাদের অব্যবহার্য প্লাস্টিক এবং পলিথিন রেখে থানচিতে নিয়ে এসে ফেলবেন।

 

 

 

Source: MehEdy HasSn NoyOn‎<Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment