ছয় দিনের সিকিম ভ্রমন গল্প

সিকিম ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য। এর তিনদিকে নেপাল, চীন আর ভূটানের বর্ডার। কাঞ্চঞ্জঙ্ঘার কোলে নর্থ সিকিম যেমন বরফে ঢাকা থাকে, আবার সাউথ সিকিমে সবুজের সমারোহ। এখানে নেপালী, ভুটানের কালচার এর প্রভাব অনেক বেশি৷ অনেক পুরোনো বুদ্ধিস্ট মনেস্ট্রি, মন্দির সিকিমকে ঐতিহাসিক জায়গা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, আবার অসাধারন সব দৃশ্য- পাহাড়, নদী, মেঘের মিলনমেলা এই সিকিম।।

১ম দিন, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯ (শনিবার):

ঢাকা কল্যানপুর থেকে শ্যামলী পরিবহনে ২০ জনের যাত্রা শুরু আমাদের বর্ডার ছিলো চ্যাংরাবান্ধা-বুড়িমারী। রাত ৭.৩০ এ যাএা শুরু করি কল্যাণপুর থেকে, এর মধ্যে রাত ১১.০০ টায় বগুড়ার “ফুড ভিলেজে ” যাত্রাবিরতি দেয়া হয় রাতের খাবার ও বগুড়ার দই taste করি।

২য় দিন, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯ (রবিবার):

‌সকাল ৬,০০ আমরা চ্যাংরাবান্ধা গিয়ে পৌছায়, তাড়াতাড়ি যাওয়ার কারণে শ্যামলীর রেস্ট রুমে ৮ টা পর্যন্ত বিশ্রাম নেই, মাঝে মধ্যে সামনের টং এর চা খেয়ে ঠান্ডা ধাওয়াই 😁 ৮টায় আমারা বুড়ীর হোটেল থেকে বছরের শেষ দেশের খাবার খেয়ে নেই, খাবার টা ছিলো অসাধারণ। আমরা বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন এ যাই ও ৩০-৪০ মিনিট এর মধ্যে সব কাজ শেষ করে ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন এ চলে যাই। জিরো পয়েন্ট এ ডলার, টাকা থেকে রুপি করে নেই, ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন শেষ করে ১০.৩০ টায় শ্যামলীর মিনি বাসে এ উঠে পরি

ওয়েলকাম টু ইন্ডিয়া 😁 নতুন জায়গায় সামনে সিট এ বসে মজাই আলাদা, ড্রাইভার, হেল্পার এর সাথে কথা বলতে বলতে একের পরে এক ময়নাগুড়ী, জলপাইগুড়ি পার করে ১২.৪৫ এ শিলিগুড়িতে চলে আসি, সেখানে আমাদের সাথে আরো দুইজন যোগদান করে তাদের বর্ডার ছিলো বাংলাবান্ধা। তার পরে আমরা তিনজন সিকিমের পারমিশন ILP (INNER LINE PERMIT) এর জন্য চলে যাই, কিন্তু রবিবার এর কারণে শিলিগুড়ি অফিস বন্ধ ছিলো তাই শিলিগুড়িতে ফ্রেশ হয়ে ও চা-নাস্তা করে ২টার দিকে গ্যাংটক এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। যাত্রা পথে ৫.০০ টার দিকে দুপুরের খাবার খেয়ে নেই, আমাদের টার্গেট ছিলো ৭ টার আগে সিকিমের পারমিশন ILP(INNER LINE PERMIT) জন্য Rangpo Checkpoint চলে যাওয়া। Rangpo Checkpoint সবার পাসপোর্ট, ভিসার ফটোকপি ও ছবি নিয়ে ইমিগ্রেশনে যাই এবং অফিসার খুব সুন্দর ভাবে আমাকে বুঝিয়ে বলে কি করতে হবে, ১৫-২০ মিনিট এর মধ্যে সব পারমিশন ও পাসপোর্ট এ সিল মারা শেষ 😁 ওয়েলকাম টু সিকিম। অবশেষে রাত ৮ঃ০০ টায় থেকে ১২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ৫৪০০ ফুট উচ্চতায় গ্যাংটক শহরে প্রবেশ করলাম। আমাদের হোটেল ছিলো MG মার্কেট থেকে ১০ মিনিট এর গাড়ির রাস্তা, হোটেলে গিজার এবং ওয়াইফাই এর সুবিধা ছিলো।

হোটেল জানালা খুলতেই অবাক! মনে হচ্ছিলো আকাশের তারাগুলো সব মাটিতে নেমে এসেছে। ওপাশের পাহাড়ের ঘরবাড়ি থেকে ইলেকট্রিক লাইটের আলো এপাশ থেকে তারার মেলার মতোই মনে হচ্ছিলো, ততক্ষনে শীতে হাত-পা ঠান্ডা হওয়া শুরু করে দিয়েছে🥶। হোটেলের নিচেই রাতের খাবারের ব্যাবস্থা ছিলো আমাদের তাই রাতের খাবার শেষ করি, টানা ২৫ ঘন্টা জার্নি করে আসার পরে শরীর আর চলছে না কিন্তু নাছড়বান্ধা মন তাই রাস্তায় নেমে পরি হাটাহাটি করতে ২০ মিনিট হাটাহাটি করার পরে রুমে এসে একটা শীতের ঘুম ☺।

৩য় দিন, ৩০ডিসেম্বর (সোমবার):

সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে এইবার সকালের খাবার এর পালা, লুচি-আলুর ডাল ও ডিম সাথে চা দিয়ে সকালের নাস্তা করে, লাচুং যাওয়া জন্য ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম (দরকারি কাপড় ও কাগজ) বাকি ব্যাগ হোটেলের একটা রুমে রেখে ট্যাক্সি নিয়ে জীপ স্টেশন এ চলে গেলাম। আমাদের আগে থেকেই সব বুকিং করাছিলো, ১১টার দিকে ৩টা জীপ নিয়ে ল্যাচুং এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু। পাহাড়ি আঁকাবাকা পথ দিয়ে আমরা লাচুং এর দিকে এগুতে থাকি। যাএাপথে আমরা প্যাকেজ এর lunch করি, এর মধ্যে আমরা Seven sister falls, Kanchanjangha view point, naga falls সহ আরও কয়েকটা স্পট ঘুরে সন্ধ্যা ৭ঃ০০ টায় প্রায় লাচুং পৌছায়। লাচুং এ প্রবেশের সাথে সাথে প্রচন্ড ঠান্ডা লাগা শুরু করে,তাপমাত্রা ছিলো -৬°C🥶 হোটেলে চেক-ইন করে আমরা কনকনে ঠান্ডার মধ্যে মল চা দিয়ে সন্ধ্যার নাস্তা সেরে নেই, এরপর হোটেলের আসেপাসে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে ৮ঃ০০ প্যাকেজের খাবার মুরগী, ভাত, সবজি ও ডাল দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নেই, প্রচন্ড ঠান্ডা ছিলো কিন্তু বাঙ্গালীদের ঠান্ডায় দমাতে পারিনি আমাদের কয়েক জন মিলে রাস্তায় মজা করে, তারপরে রুমে কয়েকজন মিলে গানের আড্ডা দেই ১২.৩০ দিকে ঘুম😴।
(লাচুং এ ঢোকার আগে আমাদের সাথে যত ধরনের প্লাস্টিকের বোতল ছিলো সব ফেলে দিতে হয়েছে কারণ লাচুং এ প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ,তাই আমারা পানির পট নিয়ে নেই)।

৪র্থ দিন, ৩১ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার):

খুব সকালে ৬:০০ টায় আমরা জিরো পয়েন্ট এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম, সাথে সকালের নাস্তা নিয়ে নিলাম। তখন থেকেই মনের মধ্যে একটা অন্যরকম excitement কাজ করতেছিলো। লাচুং থেকে আমরা জিরো পয়েন্টের দিকে উঠতে থাকি এবং উপরে উঠতে উঠতে বুঝতে পারলাম যে আমার হালকা breathing problem হচ্ছিল। ১০ঃ৩০ দিকে আমরা প্রায় ১৫৪০০ ফুট উচ্চতায় জিরো পয়েন্টে পৌছালাম। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি যে কি হতে পারে তা না দেখলে বুঝা যায়না, আমার মনে হয় যদি আমরা জিরো পয়েন্ট যেতে না পারতাম তাইলে আমাদের ট্যুরটা স্বয়সম্পুর্ন হতোনা। জিরো পয়েন্ট যে কি জিনিস তা লিখে বুঝানো যাবেনা। এর পর আমরা জিরো পয়েন্টে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে ম্যাগী খেয়ে শরীর গরম করে ইয়ামতাং ভ্যালীর দিকে রওনা দিলাম। ইয়ামতাং ভ্যালীতে কিছু সময় ঘুরাঘুরি করে ল্যাচুং হোটেল এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম ১.৩০ এর মধ্যে হোটেল এ আসলাম ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। এবার গ্যাংটক ফেরার পালা, ফেরার পথে অমিতাভ বচ্চন ফলস দেখে ৯.৩০ টায় রুমে চলে আসলাম। রাতে সবাই মিলে 31st উৎজ্জাপন করলাম (লাইফের সেরা ৩১st ছিলো)।
(লাচুং থেকে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত বেশ কয়েকটা সেনাবাহিনীর ক্যাম্প আছে এইগুলোর সীমানাতে ছবি তুলা নিষিদ্ধ)

৫ম দিন, ১ জানুয়ারি (বুধবার):

সকালের নাস্তা করে ৯ঃ৩০ দিকে গাড়ি নিয়ে আমরা ছাঙ্গু লেকের উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। যাওয়ার পথে আমাদের বলা হলো আমারা যেন ১.৩০ আগে ফিরে আসি Snow fall হবে, শুনে আমরা তো অনেক খুশি। ১১ঃ৪০ আমরা ছাঙ্গু লেক পৌছায়, আমরা যখন ছাঙ্গু লেক পৌছায় তখন আকাশে মিষ্টি রোদ ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশের ওই ঝকঝকে রোদের বদলে চারিদিকে মেঘের আনাগোনা দেখতে শুরু করলাম। পুরো এলাকা মেঘে সাদা হয়ে গেলো, ছাঙ্গুর দুইরুপ আমরা বেশ খানিকটা সময় নিয়ে উপভোগ করলাম। এর পর ১.৪০ গ্যাংটক উদ্দেশ্য রওনা দিলাম, ৪.০০ টার মধ্যে হোটেল এ চলে আসলাম দুপুরে খাবার খেয়ে শপিং এর উদ্দেশ্যে চলে গেলাম (MG Market, Big Bazar) সাথে সিকিম এর streets food খেয়ে নিলাম। এতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শহর আর দেখিনি, কোথাও এক টুকরো কাগজ বা পলিথিন পড়ে থাকতে দেখিনি, গ্যাংটক শহরে পাবলিক প্লেসে ধূমপান একদম নিষিদ্ধ। কেউ পাবলিক প্লেসে ধূমপান বা ময়লা ফেলতে ধরা পড়লে বেশ বড় অঙ্কের জরিমানা গুনতে হয়। আর সবাই খুব সুন্দরভাবেই আইন মেনে চলে। এমনকি পুরো সময়টায় গাড়ির হর্ণ কয়বার শুনেছি গুনে বলে দেয়া যাবে। আর ওখানের মানুষগুলোও খুবই সৎ আর হেল্পফুল, ৮.০০ টার মধ্যে রুমে গিয়ে রাতের খাবার রেষ্ট নিলাম।

৬ষ্ঠ দিন, ২ জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার) :
আজকের দিন হলো আমাদের ট্যুর এর শেষ দিন।
খুব সকালে ঘুমে থেকে উঠে নাস্তা করে মিনি বাসে সব ব্যাগ গুলো সাজিয়ে ৭.৩০ এ চ্যাংরাবান্ধা উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। টার্গেট রাস্তায় দুপুরের খাবার খেয়ে নিব (শিলিগুড়িতে), কিন্তু কপাল খারাপ থাকলে আর কি করার রাস্তায় ৫.৩০ ঘন্টার প্যারা মত জ্যামের সাথে ড্রাইভারের প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ায় চ্যাংরাবান্ধা আসতে ৬.১০। মানুষের জীবনে ১০ মিনিট যে কতটা মূল্যবান এইদিন বুঝতে পারলাম😏😣৬.০০টায় বর্ডার বন্ধ হয়ে গেছে। আর কি করার বর্ডারের পাশে অথিতিশালায় রাতে থাকা ও পাশের হোটেল এ রান্নার ব্যাবস্থা করে রাতের খাবার খেয়ে ঘুম।

বরকতময় শেষ দিন (শুক্রবার):

সকালে সবার আগে ইমিগ্রেশন পার করে ১০.০০ টার মধ্যে বুড়ীর হোটেল এ আসে বুফে (হাস, খাসি, মুরগী, মাছ) দিয়ে সেরাম ভোজন।
১.৩০ এ বরকত (বাস) নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্য যাত্রা, রাতে ১.০০ টায় গাবতলি চলে আসলাম, ট্যুর এর ইতির মধ্যে।
প্রায় ২২০০ কি.মি জার্নি শেষ।

Source: Sabbir Khan‎< Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment